দাবী মোদের একটাই-‘বীরঙ্গনা পর্যটন’ চাই


ঐতিহাসিক বীরঙ্গনা সখিনার কাহিনী:  
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত মাওহা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের কেল্লা তাজপুর গ্রামটি সপ্তদশ শতাব্দীর মোঘল শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত। বার ভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর দোহিত্র ফিরোজ খাঁ আর কেল্লা তাজপুরের মোগল দেওয়ান উমর খাঁর কন্যা সখিনা বিবির স্মৃতিময় গ্রাম। এই গ্রামের কুমড়ী নামক স্থানে ইতিহাসখ্যাত পতিপ্রাণা সখিনা বিবির মাজার নামে একটি ঐতিহাসিক সমাধি সবার নজর কাড়ে। কেল্লা তাজপুরকে ঘিরে একটি ঐতিহাসিক চমকপ্রদ কাহিনী প্রচলিত আছে। কেল্লাতাজপুরের মোঘল দেওয়ান উমর খাঁর কন্য সখিনা ছিলেন অপরূপ রপবতী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। তার এই রূপ-গুণের খ্যাতি আশেপাশের সর্বত্র অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তা ৫০/৬০ মাইল দূরবর্তী বার ভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খার দোহিত্র ফিরোজ খাঁর কানেও পৌঁছে। সেই থেকে অপরূপ রূপবতী সখিনাকে এক পলক দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে ফিরোজ খাঁর অন্তর। কিন্তু দেওয়ান উমর খাঁ পরিবারের কঠোর পর্দাপ্রথা ফিরোজের ভালোবাসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে কৌশলের আশ্রয় নেয় ফিরোজ খাঁ। দরিয়া নামে এক সুন্দরী বাদীকে তসবি বিক্রেতা সাজিয়ে উমর খার অন্তঃপুরে সখিনার বাড়িতে পাঠানো হয়। দরিয়ার মুখে ফিরোজ খাঁর অসামান্য রূপগুণের কথা শুনে সদ্য যৌবনপ্রাপ্তা সখিনা নিজের অজান্তেই মনপ্রাণ সপে দেয় ফিরোজের চরণতলে। চপলমতি কন্যার হঠাৎ ম্রিয়মানা হওয়ার অন্তনির্হিত কারণ বুঝতে বাকি থাকে না খাস বাদীর। সেও সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। প্রেমালে দগ্ধ ফিরোজ খাঁ জঙ্গলবাড়িতে এসে মা ফিরোজার সম্মতি নিয়ে বিয়ে প্রস্তাব পাঠায় উমর খাঁর দরবারে। কিন্তু আভিজাত্য গৌরবে গর্বিত কন্যাপক্ষ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় সংঘাত অনবার্য হয়ে পড়েলজ্জা-ঘৃণা ক্ষোভে ফিরোজ খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে কেল্লাতাজপুর অভিযান চালায়। অতর্কিত আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরণ করে। শত্রুপক্ষের বিজয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুর নারীশূন্য হলেও সখিনার ভাবান্তর হল না। তিনি ঠাঁয় বসে থাকলেন। বিজয়ী ফিরোজ অন্তঃপুরে ঢুকে তাকে বাহুবন্দি করে জঙ্গলবাড়ী নিয়ে যাবেন এমনটিই যেন চাওয়া ছিল। হলও তাই। ইচ্ছার টানে, অনিচ্ছার ভানে সখিনা জঙ্গলবাড়িতে যান। বিয়ের মধ্যদিয়ে উভয়ের অতৃপ্ত প্রেম পূর্ণতা পায়। এদিকে, পরাজিত উমর খাঁ প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে আশপাশের হিতাকাঙ্ক্ষিদের সাহায্য প্রার্থনা করলে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেল। সম্মিলিত বিরাট বাহিনীর প্রতিআক্রমণে পরাজয় ঘটল জঙ্গলবাড়ীর সৈন্যদের। ফিরোজ খাঁ বন্দী হলেন। এরপর সখিনাকে তালাক দেয়ার জন্য বন্দির ওপর চলে চাপপ্রয়োগ। বন্দির সাফ কথা জীবন থাকতে সখিনার প্রেমের অমর্যাদা করে স্বার্থপরের মতো রাজ্যভোগ করবেন না। কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধের ময়দানে আবির্ভুত হয় সতের-আঠারো বছর বয়েসী এক অনিন্দ্যকান্তি যুবক। তার হাতের ছটায় যেন বিদ্যুৎ লাফাচ্ছে। যুবকের নেতৃত্বে ফিরোজের বিপর্যস্থ বাহিনী পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়। ক্ষ্যাপা নেকড়ের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু সৈন্যর ওপর। দুর্ধর্ষ আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী বিপন্নপ্রায়। এমন সময় ঘটল সেই নিন্দনীয় ঘটনা যা কাহিনীর কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। উমর খাঁর জনৈক উজিরের কুমন্ত্রণায় রটিয়ে দেয়া হল-যাকে উপলক্ষ্য করে এই যুদ্ধ, সেই সখিনাকে তালাক দিয়েছেন এই ফিরোজ খাঁ। আলামত হিসেবে ফিরোজের সই জাল করে দেখানো হল যুদ্ধক্ষেত্রে। মুহূর্তে পাল্টে গেল যুদ্ধের ভাব-গতি। যুবক সেনাপতির মাথা ঘুরছে, দেহ কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছ, ঘোড়ার লাগাম খসে পড়ছে আর তরবারির হাত হয়ে গেছে স্থবির। আস্তে আস্তে নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ভুলুণ্ঠিত সেনাপতির শিরোস্ত্রাণ খসে গিয়ে বের হয়ে পড়ে তার মেঘবরণ অপূর্ব চুল। সবাই দেখল এতক্ষণ যে তরুণ সেনাপতি অভূতপূর্ব রণকৌশলে যুদ্ধ করছিল সে আর কেউ নয় উমর খাঁর আদুরের দুলালী সখিনা। খবর পেয়ে ছুটে এলেন বাবা। কলিজার টুকরো কন্যার প্রাণহীন দেহ কোলে নিয়ে উন্মাদের মতো বিলাপ করলেন। সে কান্নায় জঙ্গলবাড়ীর বাতাস কী পরিমাণ ভারি হচ্ছিল জানা যায়নি, তবে এই কাহিনী শুনে পূর্ববাসীর অন্তর আজো করুণ রসে সিক্ত হয়ে ওঠে। কারো গাল বেয়ে ঝরে কয়েক ফোঁটা নোনাজল। বীরঙ্গনা নারী সখিনা যে জায়গায় মারা যান সেই কুমড়ী এলাকায় গড়ে উঠেছে তার সমাধি। বীরাঙ্গনা সখিনার এ মর্মস্পর্শী ঘটনা দেশবাসীর অজানা নয়। কবি-সাহিত্যিকরা এ নিয়ে অনেক গল্প-নাটক রচনা করেছেন। এক সময় এই ঐতিহাসিক স্থানটি উন্মুক্ত থাকলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৎকালীন গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একে এম ইহসানুল হকের প্রচেষ্টায় এর সমাধিস্থলের চারদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। এদিকে, ২০১২ সাল থেকে দি ইলেক্ট্রোরাল কমিটি ফর বীরঙ্গনা সখিনা সিলভার পেন অ্যাওয়ার্ড নামে একটি সংগঠন সখিনা বিবির নামে অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করেন। সংগঠনটির জেনারেল সেক্রেটারি রায়হান উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমরা বীরাঙ্গনা সখিনা বিবির ইতিহাসকে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য ২০১২ সাল থেকে দেশের প্রশংসনীয় ও গৌরবোজ্জ্বল ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বীরাঙ্গনা সিলভার পেন অ্যাওয়ার্ড (বিএস) পুরষ্কারের প্রবর্তন করেছি।তিনি আরো বলেন, ‘সখিনা বিবির সমাধিস্থলকে কেন্দ্র করে পর্যটন বিকাশের অপার সম্ভবনা রয়েছে। তাই এখানে পর্যটন স্পট বিকাশে যে প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দূর-রে শাহওয়াজ বলেন, ‘সখিনা বিবির সমাধিকে সম্ভনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি প্রস্তাব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে বীরাঙ্গনা সখিনার মাজারের উন্নয়ন কাজের জন্যও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে । বরাদ্দ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Contact for ad